মোদি-শি বৈঠক, দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে নতুন সমীকরণের ইঙ্গিত
প্রকাশিত : ০৯:৫৪, ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ভারত ও চীনের সম্পর্ক অনেক বছর ধরে প্রতিযোগিতা, সংঘাত এবং সন্দেহে আবদ্ধ ছিল। বিশেষ করে ২০২০ সালের গালওয়ান সংঘর্ষের পর এই সম্পর্ক একেবারে তলানিতে পৌঁছায়। কিন্তু বেইজিংয়ে শি জিনপিং ও নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক বৈঠক ইঙ্গিত দিচ্ছে, দুই দেশ এখন নতুন করে সমীকরণ গড়ছে। এখন প্রশ্ন হলো, কেন এই পরিবর্তন এবং এর গভীর তাৎপর্য কী। বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন শুল্কযুদ্ধের চাপে ভারত চীনের প্রতি আরও ঝুঁকে পড়ায় বিশ্বরাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
ড্রাগন-হাতির নাচের কূটনীতি : মোদি চীনে পৌঁছানোর পর শি জিনপিং বৈঠকে বললেন, ভারত ও চীন বিশ্বের দুটি প্রাচীন সভ্যতা এবং সবচেয়ে জনবহুল রাষ্ট্র। তাদের একসঙ্গে থাকা কেবল দুই দেশের জন্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি তিনি ‘ড্রাগন ও হাতির নাচ’-এর রূপক ব্যবহার করলেন। অন্যদিকে মোদি বললেন, পারস্পরিক বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার ভিত্তিতে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চান। সীমান্তে স্থিতিশীলতা এসেছে, সরাসরি ফ্লাইট চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছে, তীর্থযাত্রার অনুমতি মিলছে, ভিসা নিষেধাজ্ঞা শিথিল হচ্ছে। এই ভাষা এবং পদক্ষেপগুলো স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে, অতীতের সংঘাত মুছে নতুন বাস্তবতায় পা রাখছে দুই দেশ। তক্ষশীলা ইনস্টিটিউটের চীন-ভারত সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ মনোজ কেওয়ালরামানি রয়টার্সকে বলেন, ভারত ও চীন দুই দেশই একটি নতুন কৌশলগত সমীকরণ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের চাপ এবং ভারতের নতুন হিসাব : এই পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক শুল্কনীতি। মাত্র কয়েক দিন আগে ওয়াশিংটন ভারতের ওপর শুল্ক ৫০ শতাংশে বাড়িয়েছে, কারণ দিল্লি রাশিয়ার তেল কেনা অব্যাহত রেখেছে। এই শাস্তিমূলক পদক্ষেপ মোদিকে কঠিন বাস্তবতার মুখে দাঁড় করিয়েছে। ভারতের অর্থনীতি বড়ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ওপর নির্ভরশীল, কিন্তু যদি সেই বাজার সীমিত হয়, বিকল্প খুঁজতে হবে। চীন সেই বিকল্প। বাণিজ্য ও বিনিয়োগে চীনের বিশাল ক্ষমতা ভারতের জন্য সুযোগ। একই সঙ্গে চীনের সঙ্গে উত্তেজনা প্রশমিত হলে সীমান্তে নিরাপত্তাব্যয়ও কমবে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার ভাষায়, মোদি হিসাব কষে দেখেছেন বেইজিংয়ের দিকে ঝুঁকাই এখন কৌশলগত বাস্তবতা।
সীমান্ত বিরোধের পুনঃসংজ্ঞা : গালওয়ানের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ভারত-চীন সম্পর্কের প্রধান প্রতিবন্ধক ছিল সীমান্ত ইস্যু। শি এখন বলছেন, এই ইস্যুকে পুরো সম্পর্কের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে দেওয়া উচিত নয়। মোদির বক্তব্যেও মিল পাওয়া যায়, তিনি বলছেন সীমান্তে শান্তি ফিরেছে। এই অবস্থান এক ধরনের বাস্তববাদী সমঝোতা। চীন ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি, রেয়ার আর্থ উপাদান, সার ও টানেল মেশিনের রফতানি খুলে দিচ্ছে। অন্যদিকে ভারত চীনা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নরম সুর নিচ্ছে। সীমান্ত ইস্যুর ওপর জোর কমিয়ে অর্থনৈতিক সহযোগিতার দিকে ঝুঁকছে দুই দেশ।
অ-পশ্চিমা শক্তির প্ল্যাটফর্ম এসসিও : ভারত-চীনের এই ঘনিষ্ঠতা শুধুই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয় নয়, এটি বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের অংশ। সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (এসসিও) সেই পরিবর্তনের প্রধান মঞ্চ। এই সংস্থার সদস্য দেশগুলো বিশ্বের ৪২ শতাংশ জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করে, তাদের সম্মিলিত জিডিপি ২৪ ট্রিলিয়ন ডলার, আর গ্যাসের ৪৪ শতাংশ ও তেলের ২০ শতাংশ মজুত রয়েছে তাদের হাতে। রাশিয়া ও চীন এটিকে ন্যাটোর বিকল্প শক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে চাইছে। ভারত যদি এতে সক্রিয় ভূমিকা নেয়, তাহলে গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী অ-পশ্চিমা জোট গড়ে উঠবে।
বহুমেরু বিশ্বের পথে অগ্রযাত্রা : শি জিনপিং বৈঠকে স্পষ্ট বলেছেন, ভারত ও চীনকে বহুমেরু বিশ্বের বাস্তবায়নে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এর অর্থ হলো, মার্কিন নেতৃত্বাধীন এককেন্দ্রিক ব্যবস্থার যুগ শেষের দিকে। চীন চায় এসসিওকে শুধু নিরাপত্তা ফোরাম নয়, অর্থনৈতিক জোট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। ভারতের অংশগ্রহণ সেই প্রকল্পকে বৈধতা দিচ্ছে। একই সঙ্গে এটি পশ্চিমা জোটের জন্য বড় ধাক্কা, কারণ ওয়াশিংটন এতদিন ভারতকে চীনের প্রতিরোধক হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। মোদি সেই ভূমিকা থেকে সরে এসে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের পথে হাঁটছেন। জার্মানির মেরকেটর ইনস্টিটিউট ফর চায়না স্টাডিজের বিশ্লেষক ক্লাউস সাঙ আলজাজিরাকে জানান, ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধকে চীন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার সুযোগ হিসেবে দেখছে, যা কোয়াড-এর মতো মার্কিন-নেতৃত্বাধীন নিরাপত্তা জোট থেকে ভারতকে দূরে সরাতে সাহায্য করতে পারে।
অভ্যন্তরীণ সমালোচনা ও বাস্তবতার টানাপড়েন : যদিও ভারতের ভেতরে মোদির এই অবস্থান বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। কংগ্রেস অভিযোগ তুলছে, চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা মানে ২০২০ সালের গালওয়ানের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষকে ভুলে যাওয়া। কিন্তু বাস্তবতা হলো, একই সঙ্গে চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বন্দ্ব চালানো ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার স্বার্থে চীনের সঙ্গে আপস এখন মোদির কাছে কৌশলগত প্রয়োজন।
ভারত-চীনের নতুন উষ্ণতা কেবল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পরিবর্তন নয়; এটি বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্যে বড় ধরনের সরে আসার পূর্বাভাস। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাববলয় থেকে দূরে সরে গিয়ে ভারত এখন গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্বে ভূমিকা নিতে চাইছে, আর চীন সেই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে। যদি এই সমীকরণ দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে বিশ্বরাজনীতি নতুন করে মেরুকরণ হবে; যেখানে ড্রাগন ও হাতি একসঙ্গে নাচবে, আর পশ্চিমা আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাবে এক নতুন শক্তি।
এসএস//
আরও পড়ুন